বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনালি ফসল পাটের বহুমুখী ব্যবহার ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন
কৃষিবিদ ড. মুহ: রেজাউল ইসলাম১ কৃষিবিদ মোঃ অহিদুল ইসলাম২
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, পাটের গবেষণার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ এবং পাট উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে পাট সম্পদ সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর ৬ ও ১১ দফা আন্দোলনের একটি প্রধান অংশ জুড়েই ছিল পাটের কথা। পাট বাংলাদেশের ঐতিহ্যময় আঁশ উৎপাদনকারী অর্থকরী ফসল। পাট চাষ ও পাট শিল্পের সাথে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িত। স্বাধীনতার পরেও দেড় যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের অবস্থান ছিল প্রথম ও অগ্রগণ্য। পাটের মাধ্যমেই বাংলাদেশ সমগ্র বিশে^ পরিচিতি পেয়েছে এবং এ দেশে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ সম্ভবপর হয়েছে। অনুকূল জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশে বিশে^ও সর্বোৎকৃষ্ট মানের পাট উৎপাদিত হয়।
বিশে^ পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ২য় হলেও রপ্তানিতে ১ম স্থান দখল করে নিয়েছে। এর মূলে রয়েছে বিশ^ব্যাপী পলিথিন ও সিনথেটিকের ব্যবহারের পরিবর্তে পাটজাত মোড়কের ব্যবহারে আগ্রহ। কাঁচাপাট রপ্তানিতে অনেক দিন থেকেই শীর্ষস্থান বাংলাদেশের দখলে। বিগত ৫ দশকে পাটের ফলন ক্রমান্বয়ে বেড়েছে, তবে মূল্যের দিক থেকে বর্তমান দশকে পাট সবচেয়ে ভালো সময় পার করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আবাদি জমি না বাড়লেও ফলন ও উৎপাদন দুটোই বাড়াতে উন্নত পাটের জাত ও উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন আমাদের কৃষকগণ এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়।
পাটের উন্নত জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ২য় প্রধান রপ্তানিখাত হলো পাট ও পাট জাতপণ্য, ৭৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২০)।
বাংলাদেশে প্রায় ৭.০-৮.০ লাখ হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদিত হয় এবং এ চাষে প্রায় ৩.০-৩.৫ মিলিয়ন কৃষক জড়িত আছে। পাটের চাষ মূলত আঁশ ফসলের জন্য কৃষকগণ করে থাকেন। ফলে পাটবীজ উৎপাদন তাদের কাছে কম গুরুত্ব পায়। আবার পাটের বীজ উৎপাদিত হয় রবি মৌসুমে যখন মূল্যবান সবজি উৎপাদনের সময়। উল্লেখিত জমিতে পাট চাষের জন্য প্রতি বছর কৃষকদের ৪,৫০০-৫,৫০০ মে. টন পাটের বীজ প্রয়োজন হয়। সত্তরের দশক বা তার পূর্বে এদেশে দেশি (Corchorus capsularis) ও তোষা (Corchorus olitorius) পাট চাষের অনুপাত ছিল ৮০:২০ অর্থাৎ ৮০ ভাগ দেশি এবং ২০ ভাগ তোষা পাট। বর্তমান চিত্র এর ঠিক বিপরীত। অর্থাৎ ৮০ ভাগের বেশি আবাদ হচ্ছে তোষা জাতের পাট। বর্তমানে দেশি, তোষা ও কেনাফ (Hibiscus cannabinus)- মেস্তার (Hibiscus sabdariffa) অনুপাত ৮:৮৫:৭। যেহেতু পূর্বে দেশি পাটের চাষ বেশি হতো এবং দেশি পাট শুধু আমাদের দেশেই উৎপাদিত হতো, সেহেতু আমাদের পাট বীজের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু বর্তমানে তোষা পাটের চাষ বেশি হওয়ায়, পাটবীজের অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে। সরকারি, বেসরকারি ও এনজিও মিলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ১৫-২০% মানসম্মত পাটবীজ সরবরাহ হয়ে থাকে। অবশিষ্ট পাট বীজ আমদানি বা বিভিন্ন পন্থায় কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে যার গুণগত মান অনেক সময় বজায় থাকে না। এজন্য বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের স্বনির্ভর হওয়ার প্রচেষ্টা চলছে।
একদিকে সোনালি আঁশ অন্যদিকে রূপালী কাঠি-দুইয়ে মিলে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে পাট। পাটকাঠির ছাই থেকে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি, ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনী ইত্যাদি পণ্য তৈরি করা হয়।
পাট একটি প্রাকৃতিক তন্তু ও পরিবেশবান্ধব আঁশ ফসল। পাটের আঁশ থেকে সেলুলোজ সংগ্রহ করে এক ধরনের বায়োডিগ্রেডেবল শিট তৈরি করা হয়েছে। এর থেকে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এক ধরনের পলিথিন ব্যাগ উদ্ভাবন করা হয়েছে যা ‘সোনালি ব্যাগ’ নামে পরিচিত। এ সোনালি ব্যাগ ৪-৫ মাস পরে সহজে পচে যায়, মাটিতে সারের কাজ করে এবং পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি করে না। পাটের তৈরি পলিমারের ব্যাগ সাধারণ পলিব্যাগের চেয়ে দেড় গুণ টেকসই ও মজবুত। ইদানীং সোনালি ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়ছে।
পাট তথা প্রাকৃতিক তন্তু কিভাবে জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশসমৃদ্ধ করে, তা ইতোমধ্যেই উন্নত বিশ্ব অনুধাবন করে নিয়েছে। এক হেক্টর জমিতে প্রতি মৌসুমে (১০০ দিন) পাট গাছ প্রায় ১৫ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে, সেই সাথে প্রায় ১১ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে পরিবেশকে বিশুদ্ধ রাখে। এ ছাড়া ঝরে পড়া পাতা ও মূল হতে মাটিতে প্রায় ৮ মে.টন জৈব পদার্থ যোগ করে থাকে। পাট গাছের মূল মাটিতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ সেমি. গভীরে প্রবেশ করে মাটিতে থাকা অজৈব তরল খাদ্য মাটির উপরে নিয়ে আসে। এর ফলে অন্যান্য অগভীর মূল বিশিষ্ট ফসলসমূহের চাষাবাদে মাটির পুষ্টির সমস্যা হয় না এবং মাটির গুণাগুণও ঠিক থাকে। এমনকি পাট পঁচানো পানি জমির জন্য উপকারী। একইভাবে পাটের তৈরি বস্ত্র-সামগ্রী ব্যবহারের পর মাটিতে ফেললে তা পচে মাটির জৈব পদার্থের (সবুজ সার) পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এটি বৃক্ষ-ফসলের জীবনধারণ ও বৃদ্ধিতে সহায়তা। বাঁশ ও কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের ম- তৈরিতেও পাট কাঠি ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে পাট কাঠি থেকে উৎপাদিত কার্বনের গুণগত মান সর্বাধিক। তাই বিশ্ব বাজারের চাহিদা ও মূল্য দুটিই বাড়ছে। এছাড়া পলিমারের মিশ্রণে পাট থেকে আবিষ্কার করা হয়েছে পাটের ঢেউটিন যা জুটিন নামে পরিচিত।BMW কোম্পানি পাট দিয়ে তৈরি করছে পরিবেশবান্ধব ‘গ্রিনকার’ যার চাহিদা এখন সবচেয়ে বেশি। ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে গাড়ির কুশন ও অভ্যন্তরীণ ডেকোরেশনে কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। কাজেইToyota,Mitsubishi I GM Motors ইত্যাদি গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি তৎপর হয়ে উঠেছে এবং তারা পাটের আঁশ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পাট শুধু আঁশের উদ্দেশ্যে চাষ করা হয় না। মেস্তা পাটের মাংসল বৃতি (শাঁস) থেকে জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, রোজেলা চা উদ্ভাবন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (উল্লেখ্য যে, পাট পাতা এবং মেস্তার বৃতি থেকে উৎপাদিত পানীয় ‘চা’ এর কোনো ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই বলে জানা যায়)। ‘রোজেলা চা’ এ রয়েছে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা ক্যানসার প্রতিরাধী। এছাড়া এটা রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে; কোলেস্টেরল কমায়; হার্টঅ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায় ইত্যাদি। বিজেআরআইসহ কিছু প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে এই পানীয় ‘চা’ ব্যবহার শুরু করেছে।
পাটের বহুবিধ ব্যবহারের পাশাপাশি শাক হিসেবেও পাটপাতা খাওয়া যায়। দেশি পাটপাতা স্বাদে তিতা, আর তোষা পাট অনেকটা মিষ্টি লাগে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত দেশি পাটশাকের পুষ্টিসমৃদ্ধ ৩টি জাত রয়েছে, যথা : বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১, বিজেআরআই দেশি পাটশাক-২ (ম্যাড়ালাল) এবং বিজেআরআই দেশি পাটশাক-৩ (ম্যাড়াসবুজ)। এই জাতগুলো শাকের জন্যই চাষ করা হয়। দিন নিরপেক্ষ বলে এ জাতগুলো দেশের সব ধরনের জমিতে প্রায় সারা বছর চাষ করা যায়। এমনকি মৃদু লবণাক্ত এলাকাতেও চাষ করা যায়। রোগবালাই ও প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল এই জাতসমূহ অল্প যত্ন ও কম খরচে চাষ করে ২৫-৩০ দিন পর কয়েক বার শাক খাওয়া যায়। পাটশাকে রয়েছে আমিষ, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, প্রোটিন, আয়রন, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ক্যারোটিন এবং খাদ্য আঁশ। এ সকল উপাদান মানুষের শরীরে হাড় ভালো রাখে ; হজমে সাহায্য করে; খাবারে রুচি বাড়ায়; কোষ্ঠ কাঠিন্য দূর করে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়; রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে; কোলেস্টেরল কমায়; হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়; বাতব্যথা দূর করে; উচ্চমাত্রার অ্যান্টি অক্সিডেন্ট শরীরে ক্যানসার প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে ইত্যাদি। এ ছাড়া এর ফলিক অ্যাসিড ত্বক ও চুল সতেজ রাখে। তাই এই সকল রোগের জন্য পাটশাক একটি গুরুত্বপূর্র্ণ পথ্য।
পাট শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও আধুনিকায়নের ধারা বেগবান করা, পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন বাস্তবায়ন, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে প্রতি বছর ৬ মার্চ পাট দিবস উদ্যাপিত হয়। সরকারের পাটবান্ধব নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণের ফলে পাট চাষিরা বর্তমানে পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন এবং পাট চাষে দিন দিন আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে দেশে উৎপাদিত ১৯টি পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যাগ/বস্তা ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করে আইন প্রণয়ন করেছে।
পাট বাংলাদেশের পরিচিতির অন্যতম অনুষঙ্গ। দেশের প্রায় ২.৫-৩.০ মিলিয়ন মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ খাতের সাথে জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ সচেতনতার কারণে বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা নতুন করে পাট চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
বাংলাদেশের পাট শিল্পের অভিজ্ঞতা শতবর্ষ পুরনো। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জিন কোড আবিষ্কারের কৃতিত্বও দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ উন্মোচিত জীবন রহস্যের তথ্যকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে স্বল্প জীবনকালসমৃদ্ধ, প্রতিকূল পরিবেশ, রোগবালাই ও পোকামাকড় সহনশীল, বাজারের বিভিন্ন চাহিদামাফিক পণ্য উৎপাদন উপযোগী পাটের জাত উদ্ভাবনের গবেষণা এগিয়ে চলছে।
পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে বিজেআরআই নিরলসভাবে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পাটের কৃষি বিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়নে উৎকর্ষতা অর্জনই হলো বিজেআরআই এর ভিশন। আর পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের উচ্চফলনশীল জাত এবং টেকসই চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন, উন্নয়ন, হস্তান্তরের মাধ্যমে কৃষক ও সংশ্লিষ্ট উপকারভোগীদের উপার্জন বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, আত্মসামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশের উন্নয়ন করা হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য।
লেখক : ১জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার, ডিএই, গাইবান্ধা। মোবাইল-০১৭১৬৬৯৭১৯৬, ইমেইল-rezaul0171669@gmail.com ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পাট গবেষণা আঞ্চলিক কেন্দ্র, রংপুর, মোবাইল-০১৭২৩-৩৭২৯০২; ই-মেইল : wahid@bjri.gov.bd